নতুন বাংলাদেশ নতুন দিগন্ত শিক্ষা খাতের জন্য কিছু অত্যাবশ্যকীয় প্রস্তাবনা : ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ

বাংলাদেশ মতামত সর্বশেষ

আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে তারুণ্যের চেতনা, তারুণ্যের শক্তি আজ সকলের সামনে উন্মোচিত। তারুণ্যই যে এনে দিতে পারে পরিবর্তন তাতে আর সন্দেহমাত্র নেই। এক নতুন বাংলাদেশে নতুন প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে এখন উন্মুক্ত করেছে নতুন চলার পথ। আমরা আর পেছনে ফিরে তাকাতে চাই না। আমরা সেই পথে হেঁটে যেতে চাই বহুদূর। যে পথ বৈষম্যহীনতার, যে পথ অধিকারের, আর সর্বোপরি যে পথ সঠিক। এ সঠিক পথ রচনাই ছিলো আমাদের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। একটি পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েই তাদের সে আন্দোলনের সূত্রপাত। আর তাতে তাদের প্রধানতম দাবিই ছিলো মেধার সর্বোচ্চ ও সঠিক মূল্যায়ন। মেধার সঠিক বিকাশ, সঠিক ব্যবহার এবং সঠিক পথে পরিচালনা করার অদম্য আগ্রহ তাদের যুদ্ধে নামিয়েছে। এবং তারা সে যুদ্ধ জয় করে নিয়েছে। এখন আমাদের কাজই হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সেই পথ বাতলে দেওয়া যা তাদের এই অর্জনকে সত্যিকারের অর্থেই ফলপ্রসূ করে তুলবে। যার যেখানে যতটুকু সুযোগ রয়েছে- শিক্ষার্থীদের এই চাওয়াকে পূরণ করার পথে ভূমিকা রেখে চলা। সেটা করতে হবে নিঃস্বার্থ ভাবেই। আর সেটাই এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।

আমরা যখন শিক্ষার কথা বলি- চোখের সামনে হয়তো ভেসে ওঠে মক্তব কিংবা স্কুলে শিক্ষার্থীরা ঢুলে ঢুলে নামতা শিখছে কিংবা পড়া মুখস্ত করছে। সেটা আমাদের মতো যারা জেনারেশন-এক্স এর তাদের স্মৃতি। কিন্তু মিলিয়েনিয়ালস কিংবা যারা আজকের জেনারেশন-জুমারস সংক্ষেপে জেন-জি তারা শিক্ষার এই ধরনটিকে হয়তো চেনেই না। আর চেনার প্রয়োজনও নেই। তারা শিখে নেবে তাদের মতো করে। কিন্তু আমাদের যেটা করতে হবে তা হচ্ছে- তাদের জন্য তাদের মতো শিক্ষাপদ্ধতিই সামনে এনে দিতে হবে। সেখানে সনাতনী ধারায় পাঠ শেষ করে শিক্ষার্থীরা কাজের জন্য ধর্না দিতে দিতে সুকতলি খোয়াবে না। বরং আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলবো যেখানে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই তৈরি হয়ে বের হবে। প্রস্তুত থাকবে কাজের জন্য। প্রস্তুত থাকবে সরাসরি অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে এই নিবন্ধে আমার আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয়- তথা উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে সীমিত রাখবো।

এজন্য আমরা একটি শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলছি যার রয়েছে ট্রিপল মিশন- ডিগ্রি, স্কিল অ্যান্ড ক্যারিয়ার। মানে হচ্ছে যে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে যেখানে তার ডিগ্রি অর্জনতো হবেই পাশাপাশি তার কিছু দক্ষতা তৈরি হবে। আর সর্বোপরি সে প্রস্তুত হবে একটি ভালো ক্যারিয়ার গঠনের জন্যও। আবারও বলি সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা একটি শিক্ষার্থীকে কাজের বাজারে কেবল ঠেলেই দিতে পারে- তৈরি করে দিতে পারে না। যা তাদের যথেষ্টই ভোগায়। তারা কাজের বাজারে ফ্রেশার হয়ে ঢোকে। আর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় নিজেদের তৈরি করে কাজের জন্য উপযোগী করে তুলতে। ফলে সময় পার হয়ে যায় অনেকটা। অনেকেই সফল হয়। আবার অনেকেই স্রেফ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নয়তো বেছে নেয় সাদামাটা জীবনের পথ। ফলে সমাজে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়তে থাকে হতাশাগ্রস্ত যুবসমাজ। আমরা সেই সমস্যারই সমাধান খুঁজে নিতে চাই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। যে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ট্রিপল মিশন- ডিগ্রি, স্কিল ও ক্যারিয়ার এই তিনটি ধারণাকে সামনে রেখেই যার পথ চলা।

ধারণাটি অতি প্রাসঙ্গিক এবং সাম্প্রতিক। আর এর তিনটি মিশনই আলাদাভাবে বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

প্রথমেই আসা যাক ডিগ্রির কথায়। প্রচলিতভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ডিগ্রি দিয়ে আসছে, ডিগ্রি সেটাই। তাতে শিক্ষার্থীদের তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জনের সুযোগটাই শুধু থাকে। শিক্ষাক্রমের অন্তুর্ভুক্ত কিছু বই পাঠ আর শিক্ষকের লেকচারভিত্তিক জ্ঞানার্জনই এর মূল কাঠামো। গবেষণাগারে কিংবা পরীক্ষাগারে প্রাপ্ত ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ কিছুটা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবভিত্তিক কিংবা সময়োপযোগী হয় না। শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা একটি ডিগ্রি নিয়ে ঘরে ফেরে। এই ডিগ্রি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু তা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের যথেষ্টভাবে তৈরি করতে পারছে তাদের ভবিষ্যতের পথ চলার জন্য? নিশ্চয়ই নয়। সেখানেই গলদ। আমরা মনে করি, শিক্ষাক্রম কিংবা পাঠক্রমেই আনতে হবে পরিবর্তন। তাত্ত্বিক ধারণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পাঠদানের অংশ করে নিতে হবে শিল্প ও শিল্পভিত্তিক জ্ঞানকেও। ফলে পাঠক্রমটি অবশ্যই শিল্পভিত্তিক হতে হবে এবং শিল্পের চাহিদার উপর ভিত্তি করে নিয়মিত বিরতিতে এটি হালনাগাদ করা এবং প্রয়োজনে ঢেলে সাজানো উচিত। সময়ের সাথে সাথে শিল্পে যে পরিবর্তন আসে, সেই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে পাঠক্রমের আপডেট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি ডিগ্রি অর্জনে একটি বড় সময় যেমন চলে যায়, তেমনি এতে খরচও হয় একটি বড় অঙ্কের অর্থ। কিন্তু এই যে অর্থের বিনিয়োগ, তার যথার্থ রিটার্ন আসছে কি না- সেটাই এখন দেখার বিষয়। কিন্তু আগেই বলেছি- এ ধরনের সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দেয় ঠিকই কিন্তু তাদের কর্মজগতের জন্য তৈরি করে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় এখন এটা স্পষ্ট যে কাজ পেতে হলে প্রয়োজন দক্ষতা। যা এমন শিক্ষার্থীদের থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মজীবন এবং শিল্প-ভিত্তিক দক্ষতার উপর পর্যাপ্ত জোর দেওয়া হয় না, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যম পর্যায়ের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আমাদের ট্রিপল মিশনের দ্বিতীয় মিশন কিংবা ধারণাটি হলো দক্ষতা।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা পাঠের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। কিন্তু দক্ষতা কিভাবে অর্জন করবে? সে প্রশ্ন আসবেই। আর তার সহজ উত্তরটিই হচ্ছে এই পাঠদানকে বাস্তবমুখী যেমন করতে হবে, তেমনি করে তুলতে হবে প্রায়োগিকও। এখানে আমরা শিল্পভিত্তিক পাঠক্রমের যথার্থ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। আর শ্রেণিকক্ষটিকেই পাল্টে দিতে বলছি কর্মস্থলের পরিবেশে। যেখানে শিক্ষার্থীরা বই থেকে যেমন পড়বে তেমনি পাবে হাতে-কলমে অর্জিত দক্ষতা। বাস্তবভিত্তিক প্রকল্পের বাস্তবায়নের অর্জিত হবে সে দক্ষতা। আর শিল্পভিত্তিক কর্মমুখী প্রশিক্ষণের সুযোগটাও তৈরি করা হবে শ্রেণিকক্ষেই। এ কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিল্পভিত্তিক পাঠক্রমের পর শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রেই নিতে হবে কৌশলগত সিদ্ধান্ত। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আমরা তেমনই একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছি। যা সাফল্য এনে দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তারাই শিক্ষক যারা একাধারে স্কলার ও ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তারাই শিক্ষক যাদের অন্তত ৪ থেকে ৩০ বছরের ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টিজ রয়েছে। এতে তারা ইন্ডাস্ট্রি থেকে লব্ধ দক্ষতা শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসতে পারছেন। যাতে শিক্ষার্থীরা সরাসরি সেই দক্ষতাগুলোর কথাই জানছে কিংবা শিখছে যা ইন্ডাস্ট্রির জন্য উপযোগী। ইন্ডাস্ট্রি থেকে উঠে আসা এই শিক্ষকেরা একই সঙ্গে স্কলার ও প্র্যাকটিশনার। কেউ কেউ আছেন, যারা ইন্ডাস্ট্রিতেই তাদের কাজ করে যাচ্ছেন পূর্ণকালীন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে পড়াচ্ছেন খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে। এতে আরেকটি সুবিধা মিলছে। তা হচ্ছে- তারা ইন্ডাস্ট্রির সবশেষ আপডেটগুলোই শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসতে পারছেন। তাছাড়াও যেসব শিক্ষকের পর্যাপ্ত এবং আপডেটেড শিল্পভিত্তিক দক্ষতা নেই, তারা শিল্প বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে অন-জব প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন। যে সবের একটাই লক্ষ্য- শিক্ষার্থীদের সামনে ইন্ডাস্ট্রির সবশেষ প্রবণতা ও দক্ষতাগুলো হাজির করা। এবং তাদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

আমাদের ট্রিপল মিশনের তৃতীয় ধারণাটি হলো ক্যারিয়ার। কোনো জ্ঞান কিংবা দক্ষতা গুরুত্ব রাখে না, যদি না তার সঠিক ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায়। বিশেষ করে কর্মজীবনে তার প্রয়োগের ওপর আমরা জোর দিচ্ছি। আর সে কারণে বর্তমানে শিক্ষার এই তৃতীয় লক্ষ্যটি নিয়েও জোরদার আলোচনা প্রয়োজন। আগেই বলেছি রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের কথা। একটি শিক্ষার্থী যখন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে কাটিয়ে যায়, তেমনি একটি বড় অঙ্কের অর্থও ব্যয় করে তখন তার এই ইনভেস্টমেন্ট থেকে রিটার্ন কতটুকু আসবে তার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তথা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বর্তায়। সেখানেই আমরা জোর দিতে চাই। অর্থাৎ আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি এডুকেশন জার্নি নিশ্চিত করতে চাই যা তাকে কর্মজীবনে ঢুকতে ও ক্যারিয়ার গঠনেও সহায়তা করে। তৃতীয় এই মিশনের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে প্রথম দুটি মিশনকে আমরা কতটা যথার্থ ও ফলপ্রসূ করে তুলতে পেরেছি তার ওপর। শিক্ষা শেষে কর্মজগতে গিয়ে কেবল ফ্রেশার, শিক্ষানবিশ কিংবা প্রাথমিক স্তরের কিছু কাজ পেয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। এখানে আমাদের লক্ষ্যই থাকবে তারা কর্মক্ষেত্রে ঢুকবেই মধ্যম স্তরের কোনো একটি কাজ নিয়ে। উচ্চ বেতন পাবে এবং তারা তাদের ক্যারিয়ারকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ পাবে।

আমরা যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার দিকে একটু দৃষ্টি দেই দেখবো- দেশে এখন ১৭৩টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যার ৫৩টি সরকারি, ১০৭টি বেসরকারি এবং ৩টি আন্তর্জাতিক। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাড, গ্র্যাজুয়েট আর পিএইচডি প্রোগ্রামগুলোতে ১০ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। প্রতিবছর গ্র্যাজুয়েট হয়ে কর্মজগতে ঢুকছে ৮ লাখ শিক্ষার্থী। টারশিয়ারি এডুকেশন থেকেও বাড়ছে গ্র্যাজুয়েটদের সংখ্যা। অথচ এদের মধ্যে ৪৬ শতাংশই শিক্ষা শেষে কোনো কাজ পাচ্ছে না। আর যারা ঢুকছে তারাও সেখানে নিজেদের প্রমাণ করতে পারছে না। যা এক পর্যায়ে তাদের হতাশ করে তুলছে।

সাধারণ চিত্রটি এমন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষে কাজে ঢুকলে তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়োজন হয়। আর সে জন্য প্রাথমিক স্তরের ছোটখাটো কাজ নিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় কয়েকটি বছর। এতেই হতাশা দেখা যায়। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী যদি কাজে ঢোকার সময়টিতেই কোনো দক্ষতাভিত্তিক কাজে নিজের পারঙ্গমতা দেখাতে পারে তাকে আর ফিরে তাকাতে হয় না। এ জন্য দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। আমরা শিক্ষায়তন থেকেই সেই অভিজ্ঞতাটুকু শিক্ষার্থীদের ঝুলিতে যোগ করে দিতে চাই। প্রকল্পভিক্তিক, গবেষণাভিক্তিক, দক্ষতাভিত্তিক লেখাপড়া শেষ করলেই সেই অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব। এতে শিক্ষার্থীরা কেবল যে লেখাপড়া শেষে কাজ খুঁজবে তা নয়, নিজেরাও হয়ে উঠতে পারবে উদ্যোক্তা। তখন তারা কাজ খুঁজবে না, বরং কাজ দেবে। এটি আমাদের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসেরও বক্তব্য। তিনি আরও বলেন তিনটি জিরোর কথা। যার প্রধান দুটি ‘জিরো’ই হচ্ছে জিরো আনএপ্লয়মেন্ট, জিরো পোভার্টি। অর্থাৎ বেকারত্ব থাকবে না, আর তার মধ্য দিয়েই দূর হবে দারিদ্র। শিক্ষার এই দক্ষতাভিত্তিক মডেলই পারবে এই লক্ষ্য অর্জনের পথে জাতিকে এগিয়ে দিতে।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে- আমরা দেখতে পাই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের পাঠ কোনোভাবেই কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে পারছে না। এক বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্য বিষয়ে কাজ করার প্রবণতা এখানে প্রকট। এতে একজন ব্যক্তির কর্মজীবনের সম্ভাবনাকেও সীমাবদ্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের বিসিএস ক্যাডাররা এ বিষয়ে একটি বড় উদাহরণ হতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করে জীবন পার করে দেওয়ার উদাহরণ ভূরিভূরি। একমাত্র বাস্তব ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা অর্জনই পারে এর সুরাহা করতে।

কারণ এমন দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার পর শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে যায় অপার সম্ভাবনার দুয়ার। তারা কেবল কোনও একটি স্থান, কাল বা পাত্রের জন্য দক্ষ ও উপযোগী হয়ে ওঠে, তা নয়। বরং তারা হয়ে ওঠে গ্লোবাল রিসোর্স। আর আমরা সকলেই জানি দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট টুডে। অর্থাৎ অ্যান্টোনিও গ্রামসির সেই গ্লোবাল ভিলেজে, যে কেউ যে কোনো স্থানে বসে বিশ্বের যে কারো জন্য, যে কোনো স্থানের জন্য কাজ করতে পারে। সুতরাং আমাদের নিজের বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবেই গড়ে তুলতে হবে। এরই মধ্যে সে প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কিন্তু তা আজও সে অর্থে গতি পায়নি। আমরা যদি আমাদের পাশের দেশ ভারতের সাথেই তুলনা করি তারা স্রেফ আইটি খাতে আউটসোর্সিংয়ে ১৯৫ বিলিয়ন ডলার আয় করছে হরবছর। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অর্ধ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারেনি।

কিন্তু আমরা হতাশ নই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তো আরও নই। বরং আশাবাদিতায় আমরা বুক বাঁধতে পারছি। কিন্তু সফল হতে হলে আমাদের এখনই সক্রিয় হতে হবে। আমাদের ভাবনায়ও আনতে হবে পরিবর্তন। পরিবর্তন আসবে আমাদের স্বপ্নেও।

তরুণ মেধাবীরা শুধু সরকারি চাকরিকে তাদের ধ্যান-জ্ঞান না করে দক্ষতাভিত্তিক কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। আর তা কেবল দেশেই নয় তারা তৈরি হবে বিশ্বপর্যায়ে কাজ করার যোগ্য হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সে জন্য রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থার উচিত তাদের পদ্ধতিটাকেই ঢেলে সাজানো। আমাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীরা পাঠ শেষে যে প্রতিযোগিতার বাজারে প্রবেশ করবে সেটি আর জেলা, বিভাগ কিংবা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে গোটা বিশ্বটাই তার চারণভূমি, সুতরাং প্রতিযোগিতাটিও বড়। এ জন্য দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরও কতিপয় বিষয়ে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে- আন্তুর্জাতিক পরিমণ্ডলের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা জানাটাও জরুরি। সুতরাং ইংরেজির ওপর জোর দিতে হবে। যোগাযোগে পিছিয়ে থাকা যাবে না। সে জন্য ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারার দক্ষতা অত্যন্ত কার্যকর।  বৈশ্বিক নেতাদের জন্য কাজ করতে, স্নাতকদের ব্যবসায়িক ইংরেজিতে পারদর্শী হতে হবে, পাঠক্রমে কার্যকর ভাষা এবং সাংস্কৃতিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে তারা পৃথিবীর যেকোনো অংশের লোকদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে সক্ষম হয়।

সবশেষে আমি বলতে চাই শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির কথা। যা তৈরিতেও ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষায়তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রতিশ্রুতি, সময় ব্যবস্থাপনা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সহানুভূতি, সমানুভূতি ও নেতৃত্বের মতো মানবিক গুণাবলির দিকগুলো গুরুত্ব দিয়ে শেখানো উচিত। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের প্রয়োজনীয় শিল্প দক্ষতা এবং মানবিক গুণাবলি থাকে, তাহলে তারা বিশ্বের যেকোনো স্থানে তাদের প্রমাণিত করতে পারবে।

কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরা যেতে পারে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে।

এক. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা গত এক দশকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং শিক্ষার্থীরা প্রায়শই পরিবর্তিত নীতির আওতায় আসছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক শিক্ষা কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা এবং বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে ভাষা, গণিত, নৈতিকতা, পরিবেশ ও সামাজিক দায়িত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাঠ্যসূচির থিমগুলো শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে এবং উচ্চ মাধ্যমিকের স্তর বাদ দেওয়া হবে। এতে শিক্ষার্থীরা ফাউন্ডেশন কোর্স এবং কারিগরি দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। মাধ্যমিকে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি এবং পরিবেশগত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।

দুই. উচ্চ শিক্ষার স্তরে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই হাতেকলমে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা অর্জন করতে হবে। একাডেমিক কোর্সের মধ্যেই ভেন্ডর সার্টিফিকেশন অর্জনের মাধ্যমে পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন করে মার্কেটরেডি দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।

তিন. বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এমন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে যাতে তারা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। কর্মক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রবণতাগুলির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় একাডেমিক জ্ঞান প্রদানের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত, সফটস্কিল এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা অর্জনে জোর দিতে হবে, যা কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চার. অনেক নেতৃস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা নতুন স্নাতকদের সরাসরি মধ্য স্তরের পদে নিয়োগ করতে অনাগ্রহী, কারণ তাদের কার্যকারিতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। নিয়োগকর্তারা প্রায়শই চাকরিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে, এই প্রশিক্ষণের পর নতুন স্নাতকরা প্রায়ই উচ্চতর পদে অন্য নিয়োগকর্তার সাথে যুক্ত হন, যা নিয়োগকর্তাদের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে। এই সমস্যাটি নিয়োগকর্তা এবং নতুন স্নাতকদের উভয়ের জন্য হতাশাজনক হতে পারে, কারণ প্রশিক্ষণের খরচ প্রায়ই নিয়োগের সম্ভাব্য সুবিধার চেয়ে বেশি হয়ে যায়। এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে ক্যারিয়ার প্লেসমেন্ট পরিষেবাগুলির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিটি স্নাতক ন্যূনতম একটি কাজ খুঁজে পায়। এই শিক্ষা কার্যক্রমের মূল শক্তি হল ‘ট্রিপল এ’, যা হলো- অ্যাক্রিডিটেড, অ্যাফোর্ড্যাবল ও অ্যাক্সেসেবল (অনুমোদিত, সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য)।

পাঁচ: শিক্ষার্থীদেরকে বর্তমানের জটিল কর্মশক্তিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। যেমন: পেশাগত দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানে পারঙ্গমতা, কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতা ও সহযোগিতা এবং সামাজিক দায়িত্ব ও নৈতিক মূল্যবোধ। বিষয়গুলো পাঠক্রমের অংশ করে তুলতে হবে।

ছয়: সমাজে যারা বিশেষভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন ও চ্যালেঞ্জড তাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে তারা তাদের সীমিত সক্ষমতার আলোকে উন্নয়ন লাভ করতে পারবে।

সাত. শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে, যাতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং দুর্নীতি ও অপচয় কমানো যায়।

এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে, যা জেনারেশন জুমারসের প্রত্যাশা। বস্তুত আমাদের সকলের প্রত্যাশা।