উইগ শিল্পের প্রসারে সরকারি প্রণোদনা দরকার : মহসিন রহমান

শিল্প

অনেকেই আছেন যারা গতানুগতিক ধারার বাইরে টেকসই নতুন কিছু করতে চান- তাদেরই একজন বাংলাদেশি আমেরিকান মহসিন রহমান। তিনি স্বনামখ্যাত হেয়ার এবং উইগ তৈরির প্রতিষ্ঠান SunTrust Ltd. এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমেরিকার মিয়ামিতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমানে আমেরিকা, কানাডাসহ বেশ কিছু ইউরোপিয়ান দেশে বাজারজাত করছে এবং এসব দেশে অফিসও রয়েছে। বাংলাদেশের যশোরের অভয়নগর উপজেলায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন এই আর্টিফিশিয়াল চুল এবং উইগ-এর একটি আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত পণ্যই বিশ্বের দেশে দেশে সমাদৃত হচ্ছে। পরচুলা শিল্প খাতের দূরদর্শী উদ্যোক্তা মহসিন রহমানের জন্ম যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার বিভাগদী গ্রামে ১৯৭৪ সালে। তাঁর পিতা মরহুম আতিয়ার রহমান এবং মা মস্তারী বেগম। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী ও অধ্যবসায়ী মহসিন রহমান ২০০৮ সালে আমেরিকা যান এবং মার্কেট রিসার্চ ক্যারিয়ারিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন চুল হচ্ছে মানুষের মাথার এক অপার সৌন্দর্য। কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে প্রাকৃতিক কিংবা বংশগত কারণে অসংখ্য মানুষ এই সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। তাদের অনেকের মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে তবু চুল ছাড়াও চলে; কিন্তু নারীদের কাউকে চুলবিহীন দেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে যাদের চুল নেই সেসব নারী উইগ পড়েন। অতি প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য বিশ্বব্যাপী এটি শিল্প পণ্যে পরিণত হয়েছে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই দেশপ্রেমিক উদ্যোক্তা ব্যক্তিত্ব মহসিন রহমান প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের যশোর জেলার অভয়নগরে প্রতিষ্ঠা করেছেন সানট্রাস্ট লিমিটেড-এর শিল্প প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প যেমন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত তেমনি অভয়নগরের এই কারখানাতেও তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর হিউমেন হেয়ার এবং উইগস। এটি ১০০ ভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা। এখানে ৩০০০ এর অধিক কর্মী কাজ করেন যাদের প্রায় সবাই নারী। ঢাকার উত্তরায় ৭ নং সেক্টরে এই প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট অফিস গড়ে তোলা হয়েছে। পরিশ্রমী উদ্যোক্তা মহসিন রহমান ২০০৮ সালে আমেরিকায় যাবার পর মিয়ামিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি পরচুলা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে এর ব্যবসায়িক সম্ভাবনা খুঁজে পান। তিনি উপলব্ধি করেন এর শিল্প সম্ভাবনা আরো বিশাল, বিশ্বে প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি এটি; যার চাহিদা পৃথিবীর দেশে দেশে রয়েছে। এর মূল্যায়ন করেই মহসিন রহমান এ খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

কথা প্রসঙ্গে মহসিন রহমান জানান, প্রথমে তিনি একটি শোরুমের দায়িত্ব পালন করেছেন। সঞ্চয় করেছেন অভিজ্ঞতা। তারপর নিজে শোরুম দিয়েছেন মিয়ামিতে। ২০১৪-১৫ সালে তিনি শোরুম থেকেই হোল সেলার হন। নিজে চায়না থেকে আমেরিকায় পণ্য আমদানি করতেন। ২০১৭ সালে চায়না থেকে তৈরি করা ব্র্যান্ড পণ্য আমদানি শুরু করেন। এই সময় তিনি আমেরিকার মিয়ামি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে শোরুম করেন। এ সময় তিনি ভাবলেন বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের মাথার চুল আঁচড়ানোর সময় ফেলে দেয়। এগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ শুরু। তিনি ২০২০ সালে অভয়নগরে গড়ে তুলেছেন সানট্রাস্ট লিমিটেডের মূল কারখানা। মহসিন রহমান বলেন, তিনটি বিষয় বিশ্লেষণ করে তিনি বাংলাদেশেই কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এক. বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ টন চুল নষ্ট হচ্ছে। দুই. বাংলাদেশের শ্রমিক মজুরি হিসেবে পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতে কম। তিন. জন্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা। শুরু হলো তাঁর নতুন উদ্যম। এতদিন দেশের চুল কাঁচা পণ্য হিসেবে চীনসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হতো। সেখানে তিনি দেশেই এই পরচুলা তৈরির শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তিনি শুরুতে চায়না থেকে এক্সপার্ট নিয়ে আসেন, তারা এখানে কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

এখানকার স্বল্প শিক্ষিত মেয়েরা ট্রেনিং পেয়ে শুধু দক্ষ কারিগরই হননি তারা একাত্ম হয়ে প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। অভয়নগর হয়ে উঠেছে বিশ্বের উন্নত মানের হেয়ার ও উইগ তৈরির অভিজ্ঞ কর্মীদের জায়গা। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে- আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশের নারীরাই বাংলাদেশের মতো পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর স্বল্পশিক্ষিত নারীদের তৈরি উইগ ও পরচুলা ব্যবহার করছেন। তাদের মাথার চুলের সৌন্দর্যের সাথে বাংলাদেশের নারীদের শ্রম-ঘাম আন্তরিকতা যুক্ত। দেশের বাজারে বর্তমানে ফেলে দেওয়া ১ কেজি চুলের মূল্য ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। এগুলো প্রসেস করে ১০ ইঞ্চি থেকে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত বান্ডিল করা হয়। ছোট আকারের চুল ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা এবং বড় চুলের বান্ডিল ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। গ্রামগঞ্জ থেকে সংগৃহীত চুল প্রসেসিংয়ের জন্য কক্সবাজারে দুইটি কারখানা গড়ে উঠেছে। অনেক মানুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত এখন। এদেশের গার্মেন্ট শিল্প যেমন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে এবং দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ এই শিল্প থেকে আসছে- তেমনি অপ্রচলিত খাত হিসেবে চুল এবং উইগ শিল্প থেকেও বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে যার পাইওনিয়র ব্যক্তিত্ব মহসিন রহমান এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান SunTrust Ltd. মহসিন রহমান জানান, গার্মেন্ট শিল্প খাতে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়; কিন্তু এই শিল্পে তার প্রয়োজন হয় না। বরং এখানকার কাঁচামাল চীনেও রপ্তানি হচ্ছে। তিনি বলেন, অভয়নগরে উৎপাদিত উইগ এখন আমেরিকাসহ বিশ্বের ১২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই শিল্পের প্রসারে সরকারের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। মহসিন রহমান বলেন, দেশে তিনি এই শিল্পের উপযোগী একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবেন। অর্থকণ্ঠ প্রতিবেদক