সময়টা ২০০৬ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের মতো বাংলাদেশেও তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান। সেই অস্থির সময়ে একটি আনন্দের সংবাদ বাঙালিকে আপ্লুত ও উদ্বেলিত করেছিল। সংবাদটি হলো- মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল ২০০৬ সালের শান্তি পুরস্কার লাভ। সে সময় সদ্য নোবেল জয়ী ড. ইউনূস এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, মেধাবী তারুণ্যই বদলে দিতে পারে বাংলাদেশ। ওই বক্তব্যের প্রায় দেড় যুগ পর সেই তারুণ্যের শক্তিই এখন ড. ইউনূসের হাতে। এক তারুণ্যদীপ্ত বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে সমাজ-রাজনীতি পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে একটি দুর্নীতিমুক্ত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অরাজকতার বিষবাষ্প এখন যে-ই ছড়াবে, বিজয়ী ছাত্র-জনতাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ শক্তি তাকে ব্যর্থ করে দেবে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন উৎসবের মুহূর্তে এ স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে একটি অরাজকতা ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অরাজকতা আমাদের শত্রু। একে দ্রুত পরাজিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আজ দ্বিতীয়বার যারা স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের সবার জন্য সম্ভব করল, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদ ছাত্র-জনতাকে এবং এতে আহত অসংখ্য আন্দোলনকারীকে স্মরণের মাধ্যমেই দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাদের সম্মান জানাচ্ছি। তাদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ, সাহস ও সারা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া এ স্বাধীনতা অর্জন কখনোই সম্ভব হতো না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম পরিচয় তিনি একজন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। কর্মজীবন শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। অধ্যাপক ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জনক হিসেবে বিশ্ব সমাদৃত। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর পিতা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং মা সুফিয়া খাতুন। ইউনূসের শৈশব কাটে তাঁর নিজ গ্রামে। ১৯৪৪ সালে তাঁর পরিবার চট্টগ্রাম শহরে স্থায়ীভাবে চলে আসে। তিনি লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম স্থান অধিকার করেন। স্কুল জীবনে তিনি একজন সক্রিয় বয়েজ স্কাউট ছিলেন। ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডায় জাম্বুরিতে অংশগ্রহণ করেন। মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ এবং ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন।
স্নাতক শেষ করার পর তিনি গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। পরে ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ ইউনূস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুহাম্মদ ইউনূস মাতৃভূমির পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
দেশে দরিদ্রতার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম শুরু ১৯৭৪ সালে। তখন বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ চলছে। সময়ের বাস্তবতায় তিনি বুঝতে পারেন এই মুহূর্তে স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। তাই তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনূস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন অসচ্ছল ও গরিব মানুষের মধ্যে ঋণ দেবার জন্য। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। ধরনটা এ রকম— একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে এবং একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে দরিদ্র মানুষকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সাথে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। গরিবের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশসমূহ গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর যাত্রা শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ পুনর্গঠন করতে চান তিনি। তবে তাদের সামনের পথ অনেক কঠিন। শপথ নেওয়ার পর এখন সেই সরকারের করণীয় এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে কি-না, তারও চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। নতুন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বেছে নেওয়া কেন সঠিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে দ্য ওয়্যার। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, নতুন সরকার-প্রধানের জন্য ইউনূস সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হলেও তাঁর সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। তিনি এমন সময়ে সরকার-প্রধানের দায়িত্ব নিলেন, যখন দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা নেই।
‘ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কি অন্ধকার যুগ থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারবে’? এই বিশ্লেষণ আল জাজিরার। সংবাদ মাধ্যমটি বলেছে, একমাত্র নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন অনেকের ভাবনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহু বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অন্ধকার যুগ থেকে এই সরকার কীভাবে দেশকে বের করে আনবে? শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগ নিয়েও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমটি। এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। আরেকটি গুরুদায়িত্ব হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সংস্কার এনে সরকারে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো। দ্য ডন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব এখন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়া।’
ইতিহাসের মুখে শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগমুহূর্তেও কীভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন, তার বিবরণ এসেছে। কেন তাঁর এমন পরিণতি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, সেই কারণও খোঁজার চেষ্টা করেছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম।
‘ইতিহাসের বদলার মুখে বাংলাদেশের হাসিনা’ শিরোনামে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা যেভাবে স্বৈরশাসক হয়ে উঠেছিলেন, তাতে তাঁর এমন পতন ছিল অনিবার্য। স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিরোধীদের দমন, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের কণ্ঠরোধ এবং বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষুব্ধ জনতার গণভবনমুখী মিছিলের ঠিক আগমুহূর্তে পরিবারের সদস্যদের আহ্বানে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। দ্য ডন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেও বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগে অস্বীকৃতি জানায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। আর এর মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়।
হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে সূত্রের বরাতে বলা হয়, পদত্যাগের পর পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিনল্যান্ড সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন। তাতে আরও বলা হয়, এর আগে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন শেখ হাসিনা।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে ৫ চ্যালেঞ্জ
গণবিক্ষোভে রূপ নেওয়া ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে দেশটির জন্য সামনের দিনগুলো সহজ হবে না। বিশ্লেষকরাও দাবি করছেন, নতুন যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে, তাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
আইনশৃঙ্খলা : কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনে চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর তার মিত্রদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হচ্ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্মৃতি সিংহ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাক্স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ তৈরি করে দেওয়া। একই সঙ্গে নতুন করে যাতে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সরকারকে সহযোগিতা করে, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হয়ে আসবে।
অর্থনীতি : ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু এর পরও দেশটিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পাননি।
সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির পোশাক খাতকে বড় একটি নাড়া দিয়েছে। সহিংসতার সময় তৈরি পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বাংলাদেশে পোশাক কারখানা আছে সাড়ে তিন হাজার। দেশটির বার্ষিক সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে।
বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠান হুলা গ্লোবাল জানিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের বদলে অন্য দেশে দিয়েছে তারা।
ন্যায়বিচার : বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটি নির্ভর করছে আন্দোলন দমনে ব্যর্থ পুলিশ ও সংগঠিত সেনাবাহিনীর ওপর। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পুলিশপ্রধান এবং একজন শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিক্ষোভের সময় গ্রেফতারকৃত ছাত্র-জনতা ছাড়াও রাজনৈতিক বন্দীদেরও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের মতে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে কাজ শুরু করবে বলে আশা করছি এবং নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হবে— যেই ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে মানুষের। একই সঙ্গে সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।’
ক্রাইসিস গ্রুপের টমাস কিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো দায়িত্ব নিতে হবে নতুন সরকারকে।
সেনাবাহিনী : অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হবে বেসামরিক নেতৃত্বে। তবে এই সরকারে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও এই সরকারে সামরিক নেতৃত্বের বড় প্রভাব থাকবে।
নির্বাচন : গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত যে নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, সেই নির্বাচন ছিল বেশির ভাগ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক টমাস কিনের মতে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যে ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, তার একটি বড় কারণ এটি। কারণ গত ১৫ বছরে দেশটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, কবে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনে কারা অংশ নিতে পারবেন, সেসব সম্পর্কে এখনো কিছুই জানা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক আন্দোলনকে ঘিরে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। শপথ গ্রহণের সময় ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদ সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছেন। তাঁর সরকারের সামনে এখন কঠিন পথ। এমন পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব এখন ড. ইউনূসের কাঁধে। এরপর তাঁকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে চলা স্বৈরশাসনের পর ‘দরিদ্রের ব্যাংকার’ হিসেবে পরিচিত ড. ইউনূস গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারবেন। তিনি পারবেন তারুণ্যের আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে, সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে। এ দেশের মানুষ আশাবাদী, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবেন এই প্রত্যাশা সবার।