এক সময় ঘরকুনো বাঙালির অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিরা এখন বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের এ পদচারণায় বাংলাদেশ একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে, তেমনই বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এই তাঁদেরই একজন গৌরবদীপ্ত বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান এম. মুরাদ ইউসুফ সিআইপি। তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেক্সিম অস্ট্রেলিয়া পিটিই লিমিটেড, অলিভ গ্রোভ হলিডে রিসোর্ট, গ্রিন ভ্যালি ক্যাটল ফার্ম-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনিক্যাল এডুকেশন (AITE)-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও)। একইসাথে তিনি এনআরবি ওয়ার্ল্ড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট।
এম. মুরাদ ইউসুফের জন্ম ১৯৭১ সালের ২১ জুলাই ফেনীর ফতেপুর গ্রামের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পিতা মরহুম মাস্টার মমতাজউদ্দিন ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মা রাবিয়া খাতুন সুগৃহিণী। মুরাদ ইউসুফ ১৯৮৯ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার্থে সিঙ্গাপুর যান। তিনি ১৯৯২ সালে সিঙ্গাপুরের Informatics Computer College থেকে অ্যাডভান্স ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার স্টাডিজ (এডিসিএস) সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের কম্পিউটার স্কুল Livale Training Center Pty Ltd.-এ সিনিয়র প্রোগ্রামার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুরাদ ইউসুফ সিঙ্গাপুরে স্থায়ী বসবাসের (পিআর) অনুমোদন পাওয়ার পরে ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসে সেখানে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট প্রতিষ্ঠান সিগনেট ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২০০২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং ব্যবসা পরিচালনা করেন।
মুরাদ ইউসুফ ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন এবং Crib USA Pty Ltd প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাপড়ের হোল সেল ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ২০০৪ সালে এখানেও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস প্রতিষ্ঠান মেক্সিম অস্ট্রেলিয়া প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুরু থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশসহ প্রায় ১২টি দেশে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা পরিচালনা করছে। তিনি ১৯৯৬ সালে সান মুন শিপিং ইন্টারন্যাশনাল পিটিই নামে শিপিং কোম্পানি শুরু করেন। মুরাদ ইউসুফ ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মেক্সিম প্যাসিফিক কোম্পানি লিমিটেড। তিনি ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন গবীরস Mexim Newzealand Ltd, Newzealand এবং একই বছর আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করেন গবীরস Mexim Distributor USA INC, NY তিনি সব প্রতিষ্ঠানেরই ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকেও বিশুদ্ধ ফ্রোজেন খাবার, সবজি, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানি করছেন।
বাংলাদেশের এই গর্বিত সন্তান অস্ট্রেলিয়ার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস অঙ্গনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি বর্তমানে দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সলোমন আইল্যান্ডের রাজধানী Honiara ও নিউজিল্যান্ডে অফিস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছেন।
মুরাদ ইউসুফের স্ত্রী সাবরিনা ইউসুফও একজন উদ্যামী নারী। তিনি গৃহকর্মের পাশাপাশি গবীরস Mexim Group-এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সুখী এই দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে। সন্তানদের মধ্যে দুই ছেলে ও এক মেয়ে মোনাস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করছেন। কনিষ্ঠ ছেলে গ্রেড-৩ এর ছাত্র। উল্লেখ্য, মুরাদ ইউসুফ মেলবোর্নের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন এবং বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ে পিএইচডি করছেন। অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এম. মুরাদ ইউসুফ সিআইপি সম্প্রতি অর্থকণ্ঠকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে যা বলেন, তা এখানে উপস্থাপন করা হলো :
অর্থকণ্ঠ : আপনি বাংলাদেশের একজন কৃতী সন্তান। বর্তমানে আপনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ও ব্যবসায়ী। এই উন্নয়ন ও অবস্থানে উঠে আসার পেছনে কোন কোন বিষয় কাজ করেছে?
এম. মুরাদ ইউসুফ : আমার বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি তাঁর ছাত্রদের অধ্যবসায়ী, উদ্যমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী হবার শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, ‘ভালোভাবে পড়াশোনা করে তাকে কাজে লাগাতে হবে। সীমাবদ্ধতা থাকলেও মানুষ তার স্বপ্ন পূরণের পথে অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে’। আমি মায়ের কাছ থেকে আমার পথপ্রদর্শক পিতার এই মহান আদর্শ শিক্ষাকে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি এবং সে অনুযায়ী পথ চলেছি। আমি আমার আদর্শ পিতার সেই কথাগুলো মন থেকে রপ্ত করেছি। যখন যে কাজটি করেছি সবই আন্তরিকতার সাথে। আমার মধ্যে একটি বিষয় কাজ করেছে যে, আমি যখন বিদেশে আছি- আমাকে এমন কিছু করতে হবে, যাতে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারি; দেশের উন্নয়নে কাজ করতে এবং মানুষের উপকারে আসতে পারি। এ জন্যে আমি ব্যবসা ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পণ্যকে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছি। এটি একদিক থেকে যেমন দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা সম্ভব।
একসময় পাট এবং চা ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। পরবর্তীতে গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। আমি গার্মেন্ট শিল্পের বাইরেও বাংলাদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করে শুধু অস্ট্রেলিয়া নয় আমেরিকা, নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশেও তা বাজারজাতের ব্যবস্থা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট মানের খাদ্যপণ্য সম্পর্কেও বিদেশিরা জানতে পারছে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে আমি প্রমোট করছি ব্যবসার মাধ্যমে। আমি প্রবাসেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছি।
অর্থকণ্ঠ : অতীতে বাংলাদেশ ছিল দরিদ্র একটি রাষ্ট্র। বর্তমানে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকা অতিক্রম করে মধ্যম আয়ের দ্বারপ্রান্তে। দেশের এই উন্নয়নে আপনার অনুভূতি কি?
এম. মুরাদ ইউসুফ : একটি বিষয় নিয়ে সব সময় চিন্তা করি যে, আমার জন্ম বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে- এ জন্যে আমি গর্বিত। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য পৃথিবীর অন্য সব দেশের চেয়ে আলাদা। আমরা ১৯৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছি। ১৯৭১ সালে অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এতো গৌরবপূর্ণ ইতিহাস ক’টি দেশের আছে বলুন? সেই দেশের মানুষ উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক। একসময় বাংলাদেশ দরিদ্র রাষ্ট্র হবার কারণও ছিল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতার আগে দুইশ’ বছর ব্রিটিশরা আমাদের শোষণ করেছিল। এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বাধীন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের পূর্ব বঙ্গকে নানাভাবে শোষণ করেছে। নির্যাতন করেছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। সেই স্বাধীনতার বয়স এখন ৫৩ বছর। এই সময়ে আমরা বেশ এগিয়েছি। বিশেষ করে শিল্পায়ন, জনশক্তি রপ্তানি ও দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছি। একই সাথে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক নারী দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে কাজ করছেন, নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার সুবাদে আয়তনে ছোট হলেও ১৭ কোটি মানুষ দু’বেলা খাবার পাচ্ছে। দেশে মাতৃ ও শিশুর মৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে। নারীরা গার্মেন্ট শিল্পে ব্যাপকভাবে কাজের সুযোগ পেয়েছেন, বিদেশেও বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। সার্বিক অর্থে বাংলাদেশ স্বনির্ভর রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে এটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত গর্বের, অনেক আনন্দের। আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাছে এসব ইতিহাস বলি। তারাও খুব অনুপ্রাণিত হয়, বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ববোধ করে।
অর্থকণ্ঠ : আপনি অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট এবং এনআরবি ওয়ার্ল্ড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনাদের আগামী পরিকল্পনা কি?
এম. মুরাদ ইউসুফ : ছোট বেলায় একটা বিজ্ঞাপন দেখতাম ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’। এটি সত্য যে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সুবাদে আমরা এখন গ্লোবাল ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। এখন বিশ্বের এক দেশ আরেক দেশের চাইতে খুব বেশি দূরত্বে নেই। একটা মুঠোফোনেই কি চমৎকারভাবে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও আপনার সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে পারছি। যারা প্রবাসে থাকি- তারা নিজ দেশের উন্নয়ন নিয়েও ভাবি এবং এ ভাবনা থেকেই আমি আমার মেক্সিম গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাপড়, হিমায়িত খাদ্যসামগ্রী এবং অন্যান্য পণ্য বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছি।
আমরা চাই বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন হোক। দেশে প্রচুর শিল্পায়ন হোক। সদ্য বিদায়ী সরকার প্রায় প্রতি জেলায় ইপিজেড নির্মাণ করে শিল্পায়নের অধিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনেক বিদেশি উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন এবং আরও অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন। আমরা এনআরবিরা বিদেশি উদ্যোক্তা- ব্যবসায়ীদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত করছি। আপনারা জেনে থাকবেন, বাংলাদেশের যে সকল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছি আমাদের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে এনআরবি ওয়ার্ল্ড। এ সংগঠন অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে; এসবের মধ্যে একটি হচ্ছে বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা। আমরা সে কাজটি করছি।
অর্থকণ্ঠ : সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন কোন সমস্যা সম্পর্কে বিদেশিরা আপনাদের জানায়?
এম. মুরাদ ইউসুফ : তারা প্রথমেই জানায়- বাংলাদেশের প্রবল যানজটের কথা। দুর্নীতি এবং অনিয়মের কথা। এদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, বিনিয়োগের জন্যে বাংলাদেশ হচ্ছে স্বর্ণভূমি। কারণ, এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, এখানে শ্রমের মূল্য এখনো স্বল্প। দেশের মানুষ বেশ আন্তরিক। তারপরও উল্লিখিত সমস্যাসহ পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব বোধের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আশাব্যঞ্জক হচ্ছে না।
আরও একটি বিষয় বলবো, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকেও সক্রিয় হতে হবে। দূতাবাস কর্মীদের মধ্যে দেশপ্রেম থাকতে হবে। তারা যে দেশের টাকায় বিদেশে চাকরি করছেন সে দেশের স্বার্থ রক্ষায় তাদের আরও তৎপর হতে হবে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।
অর্থকণ্ঠ : অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ শোনা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হয়রানির শিকার হতে হয়; এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কি?
এম. মুরাদ ইউসুফ : পত্র-পত্রিকায় দেখি, পরিচিতজনরাও এই ধরনের অভিযোগ করেন। আমি এটাকে শুধু দুঃখজনক বলবো না, এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা অহেতুক প্রবাসীদের সম্মানের পরিবর্তে হয়রানি করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখা উচিত- প্রবাসীদের অনেকে স্বল্প শিক্ষিত হলেও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। আমরা আজ বিশ্বের উন্নত দেশের তালিকায় স্থান পাবার অপেক্ষায় আছি।
অর্থকণ্ঠ : আপনি মেক্সিম গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্যকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করছেন। এ ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং সতর্কতা অবলম্বন করি। আমরা বিশ্বের ১২টি দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ করি। তবে বাংলাদেশকে অধিক প্রাধান্য দেই। বাংলাদেশের যে সব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আনা হয় তাদের কর্মীদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি- কিভাবে ফ্রোজেন ফুড এবং ড্রাইফুড সংরক্ষণ করতে হয়। আমাদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে শুধু আমার প্রতিষ্ঠানই নয়, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও বিশ্বস্ততার সাথে পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ পাচ্ছে।
আমরা যে টিমকে ট্রেইন্ডআপ করে দিয়েছি, সেই টিম অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে পারছে। সারা অস্ট্রেলিয়ার যেখানেই যাবেন দেখবেন, আমাদের মেক্সিম-এর মাধ্যমে বাজারজাত করা অনেক ধরনের খাবার আইটেম পাবেন।
অর্থকণ্ঠ : আপনি এনআরবি ওয়ার্ল্ড-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এ সংগঠন দেশের উন্নয়নে কি কি উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : বিশ্বের ৫০টির অধিক দেশে এখন ১ কোটি ২০ লাখের অধিক বাংলাদেশিরা রয়েছেন। তারা শুধু যে চাকরি করছেন তাই নয়, অনেকেই সে সব দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। সরকারের উচিত প্রত্যেক দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে একটা সেল রাখা যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবে। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যা সম্পর্কে দেশের সরকারও জানতে পারবে। একইসাথে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উন্নয়ন প্রস্তাব কিংবা বিনিয়োগ প্রস্তাবকেও গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। এনআরবিদের যোগ্যতা অনুযায়ী সিআইপি হিসেবে সম্মান দিতে হবে, অবশ্য এখন এটি চালু রয়েছে। তবে এনআরবি ওয়ার্ল্ডেরও দায়িত্ব হচ্ছে সর্বাবস্থায় দেশের স্বার্থ রক্ষা করা।
অর্থকণ্ঠ : আপনি বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিষয়ে কথা বললেন। এগুলো বন্ধে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে প্রত্যেক সরকারই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন; কিন্তু দেশে দুর্নীতি এবং অনিয়ম বন্ধ করা যায়নি। এর কারণ, অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, প্রশাসনিক প্রশ্রয় পায় এবং বিচার কার্যক্রম এখানে দীর্ঘায়িত হওয়ায় সঠিকভাবে বিচার হয় না। সরকারের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেয়া উচিত। দুর্নীতিবাজরা সংখ্যায় খুবই কম কিন্তু তাদের জন্যে দেশের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেকেই দুর্নীতির টাকায় ব্রিটেন, কানাডা, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন; তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
অর্থকণ্ঠ : অস্ট্রেলিয়ায় এখন অনেক বাংলাদেশি রয়েছেন। আপনারা বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে কিভাবে তুলে ধরছেন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটিগুলো নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উদযাপনে বেশ তৎপর। আমরা বিশেষ দিনগুলো যেমন অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি বেশ আড়ম্বরে পালন করি। আমাদের এ উদ্যোগের সুবাদে এখানকার নতুন প্রজন্ম দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশকে তারা উপলব্ধি করতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন কমিউনিটি বাংলাদেশের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আমাদের এই বিনোদন অন্যান্য ভাষাভাষী লোকদেরকেও আগ্রহী করে তোলে।
অর্থকণ্ঠ : বাংলাদেশে আপনি কোন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন বা নেয়ার চিন্তা করছেন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : দেশের বিভিন্ন দুর্যোগকালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকি। আমি নিজ এলাকার অসহায় অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করি। মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলের উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে থাকি। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কিছু ট্রেনিং সেন্টার করতে চাই। যে ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো যাতে তারা ভালো বেতনে কাজের সুযোগ পায়। আমি মনে করি, বর্তমানে বাংলাদেশের যে পাঠক্রম রয়েছে সেখানে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। বিদেশে নার্সিংয়ের চাহিদা রয়েছে; এ সংক্রান্ত অধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত।
অর্থকণ্ঠ : আপনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে কি ধরনের আশা করেন?
এম. মুরাদ ইউসুফ : উন্নত দেশতো অবশ্যই। তবে সেই সাথে আমি একটি শতভাগ শিক্ষিত ও মানবিক বাংলাদেশ চাই। যেখানে বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা হবে নির্মোহ। দেশে বহু দল থাকবে কিন্তু প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করবে। সরকার ব্যবস্থায় দলীয়করণ নয়, দেশের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ আমাদের শ্রদ্ধা করবে, সম্মান জানাবে।