সফল এক স্বপ্নসারথির বিদায়

সংবাদ

বোরহান উদ্দিন 
‘প্রিয়জন চলে গেলে মানুষই ব্যথিত হয়, আকাশ নির্বিকার, আকাশ কখনও নয়। 
তোমরা মানুষ তাই সহজেই দুঃখ পাও, হে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে আকাশ করে দাও।’ 
গত ১২ জুলাই শরীয়তপুরের এক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের স্মরণ সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে। আয়োজনে ছিল ঢাকাস্থ গোসাইরহাট উপজেলা সমিতি।
সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শরীয়তপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক। আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন অনেকে। ছিলেন শরীয়তপুরের বরেণ্য ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠান বেশ প্রাণবন্ত এবং সাজানো গোছানো হয়েছিল। আলোচনায় আলোচকরা বেশ জ্ঞানগর্ভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মরহুমের প্রতি আলোচকদের আলোচনা ছিল আবেগভরা এবং কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
এতক্ষণ যাঁর কথা বলছি তিনি হচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি, সমাজহিতৈষী এবং শিক্ষানুরাগী মরহুম শামসুর রহমান। যিনি শরীয়তপুর তথা দেশবাসীর কাছে শাহজাদা মিয়া নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
তাঁর জন্ম হয়েছে ব্রিটিশ ভারতে ১৯৪২ সালের ১ এপ্রিল। গ্রামের নাম হাটুরিয়া। উপজেলা গোসাইরহাট। জেলা শরীয়তপুর। ২০১৯ সালে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিষয়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেখানে ভারতবর্ষের অনেক ঘটনাই তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। কারণ ভারতবর্ষের অনেক ঘটনাই ঘটেছে তাঁর শৈশবে। ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি দেশ স্বাধীন হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। এ সব ঘটনায় আলোড়িত হয়েছেন এদেশের মানুষ। তখন শিশু শাহজাদা মিয়ার এসব ঘটনার তাৎপর্য বোঝার বয়স ছিল না। তবে তিনি পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য তাঁকে মর্মাহত করেছিল।
শাহজাদা মিয়ার পিতা মৌলভী খলিলুর রহমান এবং মাতা মোসাম্মৎ সফুরা বেগম। বাবা ছিলেন জমিদার পরিবারের। তাই আদর করে ছেলের নাম রেখেছেন শাহজাদা মিয়া।
একজন স্বাপ্নিক তরুণ
শাহজাদা মিয়ার চলনে-বলনে ছিল আভিজাত্য। এলাকার মানুষের স্নেহ ও ভালোবাসা তাঁকে স্বাপ্নিক তরুণে পরিণত করেছে। তিনি ১৯৫৭ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। তখন থেকেই তিনি মানুুষের জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবতে থাকেন। তাঁর হৃদয়ে তৈরি হতে থাকে বিরাট এক স্বপ্ন। এই অবস্থায় তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শাহজাদা মিয়ার তরুণ বয়সেই বাংলাদেশের ইতিহাসের বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়। তিনি নিজেও ছিলেন এসব ঘটনার একজন কুশীলব। সরাসরি অংশ নেন ১৯৬৬ সালের ‘৬-দফা আন্দোলনে’। তখন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ ও আবদুল জলিলের সান্নিধ্যে আসেন। শামসুর রহমান ছিলেন জাতীয় নেতা আব্দুর রাজ্জাকের বিশ্বস্ত সহযোগী। তাঁর সঙ্গ পেয়ে তিনি ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। শাহজাদা মিয়া ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বপ্ন বিজড়িত হয়ে পড়ে তাঁর দু’চোখে। তবুও তিনি বেছে নেন গতানুগতিক জীবনধারাকে। কর্মজীবন শুরু করেন আধা সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর তিনি বিসিএস সম্পন্ন করেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন বসেনি। তিনি ১৯৭৮ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেকার বসে থাকেননি। বরং তারুণ্যের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে লেগে যান। শুরু করেন ব্যবসা। তাঁর উদ্যোগ শুরু হয় আপন ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টার মধ্যদিয়ে। শেষ পর্যন্ত তা জাতীয় জীবনে উন্নয়নের কাজে লেগেছে।
শামসুর রহমানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলের নাম রেজাউর রহমান। তিনি লেদার টেকনোলজির উপর ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা সম্পন্ন করে পিতার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেজো ছেলে জিয়াউর রহমান আহাদ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ সম্পন্ন করে পিতার প্রতিষ্ঠিত বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে আসিফুর রহমান সিহাব যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাস থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করে বে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শামসুর রহমান তাঁর তিন ছেলেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। পাশাপাশি মেয়েদের লেখাপড়ার প্রতিও কোনো অবহেলা করেননি। বড় মেয়ে রাবেয়া শারমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অপর মেয়ে রোকেয়া শারমিন ইংল্যান্ডের ইস্ট এংলিয়া ইউনিভার্সিটি, নরউয়িচ, ইংল্যান্ড থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পারিবারিকভাবেও শামসুর রহমান ছিলেন একজন সফল মানুষ।
সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন লক্ষ্যের দৃঢ়তা। একজন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে শামসুর রহমান সবসময়ই দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছেন। তাতে তিনি বেশ সফলও হয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ‘বে- গ্রুপ ‘। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বে – ট্যানারিজের খ্যাতি দেশজোড়া। বিদেশেও এই প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি রয়েছে। তিনি এই গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন আমৃত্যু।
বে গ্রুপের অধীনে রয়েছে বে ফুটওয়্যার, বে রাবার, আজিজ ট্যানারি, পারুমা সু, বে এগ্রো, শালবাহান ফার্মস লিমিটেডের মতো সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান। পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বে এম্পোরিয়াম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আর একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বে ইকোনমিক জোন। স্বনামখ্যাত শিল্পোদ্যোক্তা শামসুর রহমান শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতি নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি, পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেছেন। তিনি এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠান দু’টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।
সমাজসেবায় অন্তর্ভুক্তি
শামসুর রহমান অর্থনৈতিক কার্মকাণ্ড ছাড়াও নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থেকেছেন। দেশবরেণ্য এই শিল্পোদ্যোক্তা নিজ উদ্যেগে প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাঁর গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী শামসুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকার মোহাম্মদপুরে গাউসিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, নিজ গ্রাম হাটুরিয়াতে পিতার নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন খলিলুর রহমান ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, মায়ের নামে গড়ে তুলেছেন আলহাজ্ব সফুরা বেগম শিশু সদন (এতিমখানা), সামন্তসার ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করেছেন সামন্তসার উচ্চ বিদ্যালয়। এসব ছাড়াও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে ইকরাকান্দি ও নাগেরপাড়া দাখিল মাদ্রাসায়।
সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে জাতীয় কবি নজরুল স্বর্ণ পদক সম্মানে ভূষিত হন। শামসুর রহমান নিজ এলাকায় একজন দানবীর ও জনদরদী মানুষ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ় মনোবলের মানুষ ছিলেন। অথচ আচরণে ছিলেন অসাধারণ বিনয়ী।
অত্যন্ত বিনয়ী ও সমাজহিতৈষী শামসুর রহমান শাহজাদা মিয়া গত ১৩ মে বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টায় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এই কৃতী সন্তানকে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার হাটুরিয়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, অর্থকণ্ঠ