সুইডেনে বসবাসরত বাংলাদেশি মো: রেজাউল করিম শিশির তার কাজের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। বিশ্বখ্যাত রন্ধনশিল্পী বা শেফ হিসেবে তিনি জয়ের মালা গলে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বলদি গ্রামের সন্তান। জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। পিতা হাজী মাহমুদ আলী এবং মা মোসা: দিলারা বেগম চৌধুরী। পিতা-মাতার বড় সন্তান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব বেশি ছিল। সেই দায়িত্ব পালন এবং রাজনৈতিক অক্রোশ ও সহিংসতার শিকার হয়ে তিনি ১৯৯৫ সালে সুইডেন চলে যান এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হন। এর আগে তিনি সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৯৩ সালে এসএসসি এবং ১৯৯৫ সালে মদনমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেন কৃতিত্বের সাথে। ইচ্ছে ছিল উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের, কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। সুইডেন গিয়ে বেশ কষ্টের মধ্যেই পড়েন। এমন সময় ১৯৯৭ সালে পরিচয় ঘটে তানভিনা মোহসিনের সাথে। বাংলাদেশের এই পরিবার স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭৪-৭৫ সালে সুইডেন চলে যায়। তখন কোনো ভিসা এন্ট্রি লাগতো না। পোর্ট ভিসাতেই যাওয়া যেতো। তানভিনা মোহসিনের পিতা জনাব মোহসিন তখন ওখানে বেশ প্রতিষ্ঠিত। তাদের পরিবার বেশ বড়। মোহসিন সাহেবের ৪ মেয়ে ঢাকায় আর সুইডেনে ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। রেজাউল করিমরাও ৪ ভাই ও ১ বোন; তাদের মধ্যে তিনিই বড়। তাঁর আয়ের অনেকটাই পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে হতো; কিন্তু স্ত্রী তা নিয়ে কখনো উচ্চ বাচ্য করেননি। বরং বলতেন, শুধু নিজেরা সুখী হয়ে লাভ নেই যদি পরিবারের লোকজন ভালো না থাকে। বিষয়টি রেজাউল করিমকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছে এবং নিজেকে কখনো তিনি অসহায় মনে করেননি। তিনি সব সময়েই মনে করতেন সুখে-দুঃখে স্ত্রী তানভিনা তাঁর পাশে আছেন।
তানভিনা মোহসিন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। রেজাউল করিম শিশির শুরুতে স্টকহোমে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন। এখানে দুই বছর কাজ করার মধ্য দিয়ে তাঁর মনে শেফ-এর কাজের প্রতি আগ্রহ জাগে। তিনি ভাবলেন, অন্যেরা যদি সুন্দরভাবে এ কাজটি করতে পারে তবে আমি নই কেন? তিনি ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান গার্ডেন হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তিনি তাঁর মায়ের হাতের রান্নাকেও কাজে লাগান। এটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অল্প সময়ের মধ্যেই রেজাউল করিম শিশিরের ভালো রান্নার খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৪ সালে ভালো রান্নার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি গৌরবময় সম্মাননা পদক Forsta Gulddrake অর্জন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি শেফ হিসেবে ২০০৪ সালে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি ২০০৫ সালেও Gulddrake och পদকে ভূষিত হন। ২০০৮ ও ২০১০ সালেও তিনি এই প্রেস্টিজিয়াস পদকটি পান। ২০১০ সালে বাংলাদেশের গর্বিত এই তরুণ রন্ধন শিল্পে ইংল্যান্ডের কারি শিল্পের অন্যতম পদক Taste of Britain এবং Curry Cuisine হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তাকে Curry Life in England হিসেবেও ভূষিত করা হয়। রেজাউল করিম ২০১১ সালে Best European Curry এর পদক পান। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ প্রতিবছরই তাঁর ভাগ্যে অনেক পদক জমা হতে থাকে। ২০১৪ সালে তিনি লন্ডন থেকে প্রদত্ত Best European Curry Chef Award, London অর্জন করেন। এরপর থেকে রন্ধনশিল্পে স্বনামখ্যাত এই ব্যক্তিত্বকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি সামনের দিকে এগোতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০৪ সালে সুইডেনে রেজাউল করিম শিশিরের ৫০ সিটের রেস্টুরেন্ট ছিল। সেখানে খাবারের জন্যে আগে থেকেই বুকিং দিয়ে আসতে হতো। সুইডিশরা ইন্ডিয়ান খাবার বিশেষ করে চিকেন টিকিয়া মশলা, চিকেন তন্দুরী খুব পছন্দ করতো। শিশিরের সুস্বাদু রান্নার ব্যাপ্ত এত ছড়িয়ে পড়ে যে, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চসহ অন্যান্য দেশের লোকেরাও আসতে থাকে। বর্তমানে তাঁর ১০টি রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে স্টকহোমে ৯টি এবং নর্থ শিপিং সিটিতে একটি। বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর গর্ব রেজাউল করিম শিশিরকে নিয়ে সুইডেনের প্রভাবশালী এবং ব্যাপক প্রচারিত দৈনিক Dogens Nyheters সহ অনেক পত্র-পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবারই তিনি নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন- বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যা আমরা লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ করে অর্জন করেছি। আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস অনেক গর্বের। আমরা ভাষার জন্যে লড়াই করে বাংলাভাষার সম্মান রেখেছি এজন্যে আমাদের ভাষা শহিদদের আজ বিশ্বব্যাপী স্মরণ করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইন্ডিয়ান গার্ডেন রেস্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও স্বপ্নদর্শী রেজাউল করিম শিশির বর্তমানে বিশ্বের রন্ধন শিল্প জগতের এক আলোকিত নাম। কথা প্রসঙ্গে বিশ্ব সেরা এই শেফ বলেন, আমি যেখানেই থাকি যেখানেই কাজ করি না কেন- আমার হৃদয়ে বাংলাদেশের ছবি সব সময়েই থাকে। আমি অনুপ্রাণিত ও গর্ব বোধ করি যে, আমার জন্ম বাংলাদেশে। আমি আমার মা-বাবা, ভাই-বোনদের সেই আদর স্নেহ মায়া মমতার কথা সবসময় স্মরণ করি।
জনাব শিশির তার এই উন্নয়নের পেছনে স্ত্রী তানভিনা মোহসিনের অবদানের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, তার সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা না পেলে আমি আজকের অবস্থানে উঠে আসতে পারতাম না।
রাজনীতি সচেতন রেজাউল করিম শিশির বলেন, বাংলাদেশের মানুষ পরিশ্রমী। তারা সৎ ও নির্লোভ। কিন্তু গুটিকয় রাজনীতিবিদ ও আমলার লোভের কারণে আমাদের দেশে অনিয়ম ও দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ জন্যে আমাদের লজ্জায় পড়তে হয়।
মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রত্যাশা করেন, প্রবাসীদের উপার্জিত রেমিট্যান্স যেহেতু দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে, সেহেতু তাদেরকে যেন দেশের বিমানবন্দরে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। বরং বিমানবন্দর হওয়া উচিত প্রবাসী বাংলাদেশি-বান্ধব। তিনি আরও বলেন, রন্ধন শিল্পেও যে বাংলাদেশিরা পিছিয়ে নেই তার স্বীকৃতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, দেশে ‘রন্ধন শিক্ষালয়’ গড়ে তোলা প্রয়োজন; কারণ বিদেশে এর চাহিদা আছে। তাছাড়া দেশেও রান্না করতে জানা যে কোনো তরুণ চাকরি না খুঁজে স্বাবলম্বী হতে পারে। অর্থকণ্ঠ প্রতিবেদক