দেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এ খাত সেভাবে সামনে এগোতে পারছে না। এ খাত থেকে সরকারের বিপুল অর্থ আয়ের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত থেকেছে। অপরদিকে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে এই খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অথচ সার্বিক সহযোগিতা পেলে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে পর্যটন খাত। সে জন্য এ খাতের সম্ভাবনাগুলোকে শতভাগ কাজে লাগাতে হবে বলে মনে করেন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন।
অর্থকণ্ঠ প্রতিনিধিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আমাদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, রয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রশস্ত একাধিক নদী, পাহাড়-টিলা ও সবুজ বনানী। আমাদের অসংখ্য ইউনিক ট্যুরিস্ট লোকেশন রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কাছে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। সারা বিশ্ব থেকে আমাদের দেশে যেখানে পর্যটকদের হুমড়ি খেয়ে পড়ার কথা, সেখানে আমরা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা কেবল ব্র্যান্ডিংয়ে জোর দিচ্ছি। অথচ পর্যটকরা কীভাবে যাতায়াত করবে, থাকবে কোথায়, তাদের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নত করার দিকে নজর কম। অতীতে পর্যটন মন্ত্রণালয়, করপোরেশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোয় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট কিংবা অভিজ্ঞ ছিলেন না। এর ফলে পর্যটন খাত এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সম্ভাবনা থাকলেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। তাই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।
পর্যটন খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাত ও উদ্যোক্তাদের সেভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি উল্লেখ করে মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের লাইসেন্সিং, লজিস্টিকস, আর্থিক সহযোগিতাসহ যেসব সাপোর্ট সরকারের দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হচ্ছে না। ২০০৬ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর আলী পাঁচতারকা মানের ওয়েস্টিন হোটেল চালু করেন। তাঁর দেখাদেখি পরে অন্যান্য বেসরকারি উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় এবং সরকারের সহযোগিতা সেভাবে না থাকায় বেসরকারি উদ্যোক্তারা এখন পুনর্বিনিয়োগ করবেন কি-না তা নিয়ে চিন্তিত।
শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের লাইসেন্সের জন্য ২২ প্রতিষ্ঠানে ঘুরতে হয়। এটার বদলে একটি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার হওয়া দরকার। এ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ, ট্যাক্স হলিডে ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত এবং অসংখ্য দক্ষ জনবল কর্মহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
যোগাযোগের এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছুটা উন্নতি সাধন হলেও পর্যটনে বাংলাদেশ এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসির এ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সরকারের উচিত বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা। সে জন্য তাদের যা যা প্রয়োজন, সেগুলো সহজতর করতে হবে। অপরদিকে পর্যটন খাতে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যগুলোর যদি দেশে উৎপাদন বাড়ানো যায় কিংবা আমদানিতে আরও সুবিধা দেওয়া যায়, তাহলে তা এ খাতের বিকাশকে আরও বেগবান করবে। পাশাপাশি ‘ফুড ডিপ্লোমেসি’র দিকেও নজর দিতে হবে। বিশ্বে ইন্ডিয়ান, থাই, চাইনিজ খাবারের যেমন আলাদা পরিচিতি রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশি খাবারেরও আলাদা পরিচিতি ও ব্র্যান্ডিং তৈরি করতে হবে।
দেশেই এখন এ খাতের প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যটনবিষয়ক শিক্ষা রয়েছে। এ বিষয়ে পড়াশোনা করলে কাজের অনেক সুযোগ। প্রতি বছর অনেক মেধাবী জনবল এ সেক্টরে যোগ দিচ্ছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস পিএলসি নতুনদের সুযোগ করে দিচ্ছে। সুতরাং এ খাতে দক্ষ জনবল আছে। কিন্তু তাদের শতভাগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ফলে তাদের অনেকেই বিদেশমুখী হচ্ছেন। তাই কর্মসংস্থান তৈরিতে পর্যটন খাতকে আরও উন্নত করতে হবে। এর জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ ও উদ্যোক্তাদের ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, সদ্য বিদায়ী সরকার ঠিক করেছিল ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে ৫০ লাখ পর্যটক আনবে। কিন্তু আমরা বলছি— যথাযথ উদ্যোগ থাকলে এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন সম্ভব। বর্তমানে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪ দশমিক ২ শতাংশ মাত্র। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত— ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে কীভাবে ডাবল ডিজিটে নেওয়া যায়। এটি সম্ভব। আমাদের সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, যেহেতু সরকারের একার সামর্থ্য দিয়ে অতীতে এ খাতের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। তাই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে যেতে হবে। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে আরও উৎসাহ দিতে হবে। অর্থকণ্ঠ প্রতিবেদক