দেশের সফল নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক উজ্জ্বল তারকা ব্যক্তিত্ব, কর্মে উজ্জীবিত প্রীতি চক্রবর্তী। আপন মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি মানবকল্যাণে নিবেদিত কার্যক্রম দ্বারা ইতোমধ্যেই আলোকিত নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সময়ের এই কৃতী নারী ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে ‘কসমেটিক সায়েন্স’ বিষয়ে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স সমাপ্ত করেন। সুইজারল্যান্ড থেকে তিনি ‘প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর ওপর ট্রেনিং নিয়েছেন। মেধাবী প্রীতি চক্রবর্তী সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেই কৃতিত্বের সাথে স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘স্কয়ার টয়লেট্রিজ’-এর নির্বাহী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সেখানে ৭ বছর গুরুত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। যথাযথ অভিজ্ঞতা অর্জনের পর তিনি চাকুরি ছেড়ে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মেধাবী নারী উদ্যোক্তা প্রীতি চক্রবর্তী ২০০৪ সালে ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র মহাখালীতে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল লি.-এর মালিকানা নেন। এবং এখনও এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তাঁর টিমসহ এই প্রতিষ্ঠানটিকে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা উপযোগী করে গড়ে তোলেন। ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা রূপান্তরের প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হলেন এবং যেহেতু তাঁর ইচ্ছা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা সেহেতু তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। তিনি দেশের বেসরকারি খাতের হাসপাতাল ব্যবসার ক্ষেত্রে একজন সফল উদ্যোক্তা। প্রীতি চক্রবর্তী আরও ব্যবসার সাথে আগে থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি জে এন্ড জে এসেনসিয়াল প্রোডাক্টস লিমিটেডের মাধ্যমে উৎপাদন করেন ‘Jasmin’ এবং ‘Just’ ব্র্যান্ডের দুটো প্রসাধনী সামগ্রী। তিনি ২০১০ সালে ‘সোলার এনার্জি’ খাতের ব্যবসায় যুক্ত হন। তিনি শুধু নিজের ব্যবসায়িক কর্মকা- নিয়েই ব্যস্ত নন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও মানবকল্যাণধর্মী কার্যক্রম ও সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট। তিনি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর পরিচালক, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই)-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি অর্থকন্ঠকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেন তা এখানে উপস্থাপন করা হলো:
অর্থকণ্ঠ : গত ১৬ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে তারুণ্যের বিপ্লব। এই বিজয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : ধন্যবাদ আপনাকে। তারুণ্যের বিপ্লব সবসময়ই একটি শক্তিশালী পরিবর্তনের বার্তা বহন করে। এই বিজয় শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং এটি নতুন একটি বাংলাদেশের সম্ভাবনার সূচনা করেছে। তরুণ প্রজন্মের এই উত্থান আমাদের ভবিষ্যতের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তারা প্রমাণ করেছে যে সঠিক নেতৃত্ব, ঐক্য এবং সাহসিকতার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
অর্থকণ্ঠ : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই অরাজনৈতিক সরকারের কাছে গণমানুষের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রত্যাশা কি হওয়া উচিত?
প্রীতি চক্রবর্তী : গণমানুষের প্রত্যাশা হলো সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসন। তারা চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন, যাতে জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। এছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে তা গণতন্ত্রের জন্য হবে মাইলফলক।
অর্থকণ্ঠ : রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি দ্রুত নির্বাচন দিক সরকার, কিন্তু গণমানুষ চায় বর্তমান ধারার রাজনীতির অবসান। আপনার মতামত জানতে চাইছি।
প্রীতি চক্রবর্তী : আপনি জনগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির যদি পরিবর্তন না হয় তাহলে তা কোনো সমাধান নয়। জনগণ চায় একটি স্থায়ী এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং পরিবারতন্ত্রের কোনো স্থান থাকবে না। তাই নির্বাচন যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, গণমানুষের প্রকৃত চাহিদা হলো একটি সুষম বন্টনকেন্দ্রীক সরকার। যেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে সক্ষম এবং দেশের ভবিষ্যৎকে স্থিতিশীল করবে।
অর্থকণ্ঠ : দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র ও অপরাজনীতির ধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক অবকাঠামো দরকার, যার মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির আত্মপ্রকাশ ঘটবে। এই জন্য বর্তমান সরকারকে কতদিন সময় দেয়া দরকার?
প্রীতি চক্রবর্তী : রাজনৈতিক অবকাঠামো পরিবর্তনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে, আমি বিশ্বাস করি যে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে এমন একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে যা জনগণের আস্থা অর্জন করবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হবে। এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা উচিত। তবে এ কাজসমূহ সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়োজন।
অর্থকণ্ঠ : বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক প্রতিকূল বাস্তবতা। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে আপনার পরামর্শ বলবেন কি?
প্রীতি চক্রবর্তী : ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার প্রশ্নটি বর্তমান সময়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রথমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। রপ্তানি খাতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং নতুন বাজারে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। একইসঙ্গে, দুর্নীতি দমন এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলোর সরলীকরণ অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে, যাতে অর্থনীতির সকল স্তরে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। তাহলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।
অর্থকণ্ঠ : একজন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কি কি প্রত্যাশা করেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সবার প্রথমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট স্থিতিশীল এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করি। এর পাশাপাশি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও প্রশাসনিক জটিলতা কমানোর উপরও গুরুত্বারোপ করি। এছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কর নীতিমালার স্বচ্ছতা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সহায়ক নীতি প্রণয়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
অর্থকণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনার ব্যবসাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনি কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের ব্যবসার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। মুদ্রাস্ফীতি, ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং আমদানি ব্যয়ের বৃদ্ধি ব্যবসার মুনাফায় প্রভাব ফেলেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের আয় বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি এবং বাজারের চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আমাদের পণ্য ও সেবার বৈচিত্র্য বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উপর জোর দিচ্ছি।
অর্থকণ্ঠ : ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং বাজার স্যাচুরেশনের মুখে আপনার ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রতিযোগিতামূলক রাখার বিষয়টি আপনি কীভাবে নিশ্চিত করবেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : ধন্যবাদ, আপনি সমসাময়িক বিষয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য মানের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে আমরা আমাদের পণ্য ও সেবার মান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করছি। এছাড়া বাজারের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ব্যবসার কৌশল পুনর্বিবেচনা করছি এবং নতুন বাজারের সন্ধান করছি। আমাদের গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছি।
অর্থকণ্ঠ : আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলি কি কি? আপনি কীভাবে সেগুলি মোকাবিলার পরিকল্পনা করছেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : আগামী পাঁচ বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, কর নীতির জটিলতা এবং বাজারের প্রতিযোগিতা। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের ব্যবসায়িক কৌশলকে আরও মজবুত এবং বহুমুখী করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এবং পণ্য ও সেবার গুণগত মান বৃদ্ধি করে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
অর্থকণ্ঠ : বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি এবং সেসব আপনার ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
প্রীতি চক্রবর্তী : বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেক জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। এটি ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রভাবিত এবং উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় বাধা সৃষ্টি করে। প্রশাসনিক জটিলতা এবং দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া ব্যবসার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে আমি আশাবাদী যে, প্রশাসনিক সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব।
অর্থকণ্ঠ : বিগত সরকারের আমলে কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। এখন সেগুলো কীভাবে পরিচালনা করা উচিত বলে মনে করেন?
প্রীতি চক্রবর্তী : মেগা প্রকল্পগুলো দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেগুলো সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা জরুরি। সময়মতো কাজ শেষ করতে হবে এবং প্রকল্পগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নের এই প্রকল্পগুলোতে জাতীয় স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে, যাতে দেশের জনগণ এর সুফল ভোগ করতে পারে। সঠিক তদারকি এবং সময়মতো সম্পন্ন করার মাধ্যমে মেগা প্রকল্পগুলো সফলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব।
অর্থকণ্ঠ : আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? এই ব্যাপারে আপনার কিছু সুনির্দিষ্ট পরামর্শ জানতে চাইছি-
প্রীতি চক্রবর্তী : আমি একটি উন্নত, সুশাসন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই। যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সাম্য নিশ্চিত হবে। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে একটি দুর্নীতিমুক্ত ও মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ বাংলাদেশই আমার স্বপ্ন। এজন্য সুশাসন, শিক্ষার প্রসার ও প্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব।
অর্থকণ্ঠ : ধন্যবাদ, আপনাকে। অর্থকণ্ঠকে আপনার মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রদানের জন্য।
প্রীতি চক্রবর্তী : আপনাকেও ধন্যবাদ। অর্থকণ্ঠের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি।