সুমাইয়া জামান মাত্র ৪ বছর বয়সে তার কর্মজীবন শুরু করেন রাষ্ট্রিয় মালিকানাধীন চ্যানেল বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে শিশু শিল্পী হিসেবে। ঈস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক করার পর তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে সেখানে আলোরমুখ দেখা হয়নি তার। সেটি বন্ধ হয়ে যাবার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আরেকটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যম ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে সর্বকনিষ্ঠ নারী স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। এই টিভিতেই রঙ্গমঞ্ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংবাদের একমাত্র উপস্থাপিকা হিসেবে অতন্ত্য জনপ্রিয়তা লাভ করেন অল্প দিনেই। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, সাফল্যের সিড়ি বেয়ে কর্মজীবনে একেরপর এক উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহন করে অসংখ্য সম্মান আর পুরষ্কার অর্জন করেন তিনি। বর্তমানে সুমাইয়া জাতীয় ভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ভয়েজ আর্টিস্ট ও এমসি, এবং তিনি জাতীয় জরুরী কল সেন্টার ৩৩৩ ও বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে কন্ঠ দিয়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
সাংবাদিক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমে, তারই একটি সময় টিভি। এছাড়া কাজ করেছেন দেশের একমাত্র সংবাদ রেডিও চ্যানেল রেডিও ধ্বনিতে। সেখানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে ‘টক উইথ এক্সিলেন্স’ সহ জনপ্রিয় বেশ কয়েকটি টক শো উপস্থাপনা ও পরিচালনা করতেন তিনি। রেডিও তে থাকার সময়ই ডাক পরে বৈশাখি টিভিতে। তখন থেকেই বৈশাখির ব্যবসা বানিজ্য ভিত্তিক টকশো বিজনেস বাংলাদেশে উপস্থাপিকা হিসেবে নিযুক্ত সুমাইয়া। অনলাইনের যুগে সবাই যখন নিউ মিডিয়াকে কটাক্ষ করছিল, সব কিছু উপেক্ষা করে এখানেও আশার আলো দেখেছেন সুমাইয়া। বৈশাখির পাশাপাশি তাই অনলাইন মিডিয়া সিএনয়আইতে নিউজ ও টকশো উপস্থাপনা করেছেন তিনি। তারপর গ্রিন টিভিতে সিনিওর সংবাদ উপস্থাপক এবং নিউজ্রুম এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন।
বর্তমানে সুমাইয়া আমেরিকা ভিত্তিক ম্যাগাজিন বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিনের নির্বাহি সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন।
অর্থকণ্ঠ: আপনি এনআরবি ওয়ার্ল্ড ও বিজনেস এশিয়া’র উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ‘এনআরবি ওয়ার্ল্ড সামিট ঢাকা-২০২৪’ আয়োজনের মূল লক্ষ্য কী কী?
সুমাইয়া জামান: ঠিক বলেছেন, আমরা আগামী ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার শেরাটন হোটেলে এনআরবি ওয়ার্ল্ড সামিট আয়োজন করছি। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও দেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। এতে দেশের ও বিদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের সফলতার গল্প তুলে ধরা হবে, যা বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও উজ্জীবিত করবে। ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিজনেস হাব হিসেবে পরিচিত, তাই এখানে বিনিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থকণ্ঠ: এ ধরনের সামিটে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
সুমাইয়া জামান: এটি নিঃসন্দেহে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এনআরবি উদ্যোক্তা ও দেশি উদ্যোক্তাদের একত্রিত হওয়ার সুযোগ থাকায় নতুন ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচার হবে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরবে এবং তাদের বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলবে।
অর্থকণ্ঠ: এতে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে?
সুমাইয়া জামান: বাংলাদেশ বহুমাত্রিকভাবে লাভবান হবে। প্রথমত, আমাদের দেশের ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এনআরবি ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারবেন যে, বাংলাদেশ এখন আর পিছিয়ে নেই, বরং একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এটি শিল্পায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে।
অর্থকণ্ঠ: আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি সবল করার ব্যাপারে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে?
সুমাইয়া জামান: অবশ্যই, বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। বিশ্বের কোনো দেশই এককভাবে স্বাবলম্বী নয়। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করবে।
অর্থকণ্ঠ: এই সামিটে অংশ নেয়ার ব্যাপারে এনআরবি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা কেমন সাড়া দিচ্ছেন?
সুমাইয়া জামান: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক এনআরবি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী এতে অংশগ্রহণের জন্য আগ্রহী হয়েছেন। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে উদ্যোক্তারা সাড়া দিচ্ছেন। এর পেছনে ‘এনআরবি ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘বিজনেস এশিয়া’ ম্যাগাজিনের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের সাফল্য তুলে ধরতে কাজ করছেন।
অর্থকণ্ঠ: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ ও অভিমত জানতে চাইছি।
সুমাইয়া জামান: আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পায়নে দ্রুত উন্নতি করবে। সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে আমাদের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আসবে।
উপস্থাপক হিসেবে সংবাদ উপস্থাপকদের সংগঠন ‘নিউজ ব্রডকাস্টার্স এলায়েন্স’ এবং ‘এবিসি’র একজন সম্মানীত সদস্য। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কর্নধার এবং বাংলাদেশ অনলাইন মিডিয়া এসোসিয়েশন ‘বোমা’র পরিচালনা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।
সুমাইয়া যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা তিনি সমাজের সর্ব স্তরের নারীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। এই লক্ষ্যে তিনি তার মা ও আরো কয়েকজন সমমনা নারীদের সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ প্রগ্রেসসিভে উইমেন সোসাইটি; ‘বিপিডাব্লিউএস’ নামের একটি সংস্থা। এখানে পিছিয়ে পরা ও সুবিধাবঞ্ছিত শিশু ও নারীদের জীবন উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন তিনি। এই সংস্থার একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘উন্মুক্ত পাঠাশালা’ যেখান থেকে বর্তমানে শতাধিক শিশুর শিক্ষার মাধ্যমে জীবন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সুমাইয়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র এস আই ওয়াইবি কারিকুলামের একজন গ্লোবাল মাস্টার ট্রেইনার। তিনি বাংলাদেশ এস আই ওয়াইবি ফাউন্ডেশনেরও একজন সক্রিয় সদস্য ও সংগঠনটির বর্তমান মহাসচিব। আইএলও স্বীকৃত ‘স্টার্ট এন্ড ইম্প্রভ ইউর বিজনেস’ এই কারিকুলামের মাধ্যমে সুমাইয়া প্রায় হাজার খানেক উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সার্ক চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি ও সার্ক উইমেন চেম্বারের সাথে দেশের বাইরে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন কনফারেন্স ও সেমিনারে। ভারতে আন্তর্জাতিক সুন্দরি প্রতিযোগীতার বিচারকের আসরেও জায়গা করে নিয়েছেন সুমাইয়া।
অবসর সময়ে ঘুরে বেড়াতে ও নতুন রেসিপিতে রান্না করতে পছন্দ করেন। পড়াশোনায় আগ্রহের কারণে আইন বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন থেকে এল এল বি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেলিভিশন, ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফিতে মাস্টার্সও সম্পন্ন করেন তিনি। তার পেশায় অবদানের জন্য ‘উইমেন আউট অফ দ্যা বক্স’, ‘১০০ প্রভাবশালী তরুণ’ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০২২ সালে আফ্রিকার একটি প্রতিষ্ঠান অপরচুনিটি হাবে প্রকাশিত একশ প্রভাবশালী তরুণের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়া ২০২৩ সালে বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিনের ১০০ সফল বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তার তালিকায় তার নাম উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে নারীদের নিয়ে আরো কাজ করতে চান সুমাইয়া জামান।
সাক্ষাৎকার: সুমাইয়া জামান, নির্বাহি সম্পাদক, বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিন
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: মামুনুর রশিদ
সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান: ‘এনআরবি ওয়ার্ল্ড সামিট ঢাকা-২০২৪’