‘দলীয়করণমুক্ত হওয়ার পরই সুশাসনে নজর’

সংবাদ

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা
দলীয়করণমুক্ত করার পর সুশাসনের ঘাটতির দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নজর দেওয়ার কথা তুলে ধরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সরকারের সামনে থাকা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপদেষ্টা পরিষদের যথেষ্ট শক্তি ও সাহস রয়েছে।
গণআন্দোলনের মধ্যে সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্তরে চলমান অস্থিতিশীলতা কিছুটা শান্ত হলে সরকার পরিচালনার রূপরেখা আরও পরিষ্কার করা হবে বলেও জানান তিনি।
গত ১২ আগস্ট সোমবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় সরকারের অবস্থান, অগ্রাধিকরের পাশাপাশি নিজের মন্ত্রণালয়ের বিষয়েও কথা বলেন দীর্ঘদিন থেকে পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয় রিজওয়ানা হাসান।
তিনি মনে করেন, নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক করা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং সুশাসন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
নিজের কাজের অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আমার সার্বক্ষণিক কাজ হবে পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তেও ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়েও আমাকে তৎপর থাকতে হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রবল গণআন্দোলনে রূপ নিলে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব গঠিত ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার তিন দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া প্রশাসনে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে পুলিশবিহীন কয়েক দিনে দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?-এ প্রশ্নে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, এ মুহূর্তে দেশের বড় সমস্যা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা। পুলিশ তাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এটা দেশের জন্য একটা স্বস্তি এনেছে।
তিনি বলেন, পুলিশ মাঠে নামলে একটা প্রাথমিক অবস্থানে আমরা যেতে পারব। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা ছিল। গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা এই ধরনের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে সৎ ও কর্মঠ লোক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সরবরাহে যেন কোনো ঘাটতি না হয় সেই ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। এখন আমাদের কাজ করতে হবে সুশাসন নিয়ে, দুর্নীতি নিয়ে এবং প্রশাসন নিয়ে। বিচার বিভাগে প্রচণ্ড দলীয়করণ হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে, আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সংস্কারের যেসব কথা বলা হচ্ছে তা কীভাবে শুরু হবে? কোথায় গিয়ে থামবে?-এমন প্রশ্নে আইনের ডিগ্রিধারী রিজওয়ানা হাসান বলেন, অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ এসব জায়গায় সংস্কারের মাধ্যমে আইনের শাসনে প্রাথমিক স্তম্ভগুলো গড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত করতে কী করা যায় সেটা ভাবা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দলীয়করণমুক্ত করার পর দেখা হবে সুশাসনের ঘাটতি কোথায়। কী ধরনের সেইফগার্ডগুলোর চর্চা করলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। এরপর আসবে নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক করার চ্যালেঞ্জ। এসব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ তো আসলে ইনরমাস। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং সুশাসন ফিরিয়ে আনতে প্রতিটি পদে পদে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সংখ্যালঘুদের বিস্তর অভিযোগ পাওয়ার কথা তুলে ধরে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান. মন্দির এগুলোর ওপর আঘাত আসছে। এসব বিষয়ে অতি তাড়াতাড়ি হ্রাস টানতে হচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি, সাহস ও দক্ষতা আমাদের টিমের রয়েছে। এখন এই টিম কতটা ভালো, কতটা দুর্বল, কোথায় দুর্বলতা সেগুলো বোঝার জন্য তো কিছুদিন কাজ করতে হবে।
পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার ও প্রশাসনকে এতদিন চাপ দিয়ে আসছিলেন ২০১২ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার পাওয়া রিজওয়ানা হাসান। এখন সরকারে এসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এটাকে সুযোগ হিসেবেই দেখছি। মাঠ পর্যায়ের কাজ আমি বন্ধ করব না। ৩০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এখন মাঠে না গেলেও মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে পারি। এতদিন আমি যে কাঠামোতে কাজ করেছি এখনকার কাঠামো ভিন্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের সংস্কারের যে স্লোগান তুলেছি- সেটা ধরে আমরা কাজ করব।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র থাকবে। কিন্তু আমলাতন্ত্র যদি মানুষের অভিগম্যতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেটা আমাদের জন্য উপকারি কিছু হবে না। শুধু বইয়ের ভাষায় পড়ে থাকলে তো হবে না। এখানে আমি সংস্কারের কথা বলব।
দায়িত্বে থাকাকালে শহরাঞ্চলের খেলার মাঠ, পার্ক, পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা এবং জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো অন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও পরিবেশের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব নিয়েও সরব থাকব। কাজ করব সমন্বয় করে, কিন্তু কথা তো বলতেই হবে।
মন্ত্রণালয়ের নতুন দায়িত্বে এসে প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, সদ্য বিদায়ী যিনি মন্ত্রী (সাবের হোসেন চৌধুরী) ছিলেন তাকে সজ্জন ও জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে সবাই মনে করে। তিনি আমাদের সবাইকে সাথে নিয়েই একটা কর্মপরিকল্পনা করেছিলেন। সেই কর্মপরিকল্পনা যেভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছিল সেভাবে হতে থাকবে।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, কতগুলো জায়গায় দ্রুত ফল পাওয়ার চেষ্টা করব। যেমন পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার। বন সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ। সব বনই রক্ষা করা হবে। তবে দুই-একটি বন অচিরেই সংরক্ষণ করা হবে।
শব্দ দূষণকে অন্যতম সমস্যা হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের সাথে শিক্ষার্থীরাও ছিল। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পলিথিন বাজার থেকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হবে। আমরা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক রাখব না। আগের সব পরিকল্পনাই ঠিক আছে। তবে নতুন কিছু যোগ হতে পারে।
তিনি বলেন, ইটভাটার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান রয়েছে। সরকার নীতি করেছিল কিন্তু বাস্তবায়ন করছিল না। আমরা এখন বাস্তবায়নের দিকে যাব। অর্থকণ্ঠ ডেস্ক