অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আমাদের সফল হতেই হবে। গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিন পর জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় ভাষণে নিজের কর্ম-পরিকল্পনার ধারণা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন সাপেক্ষ তা বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন তিনি।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রিয় দেশবাসী, আপনারা জানেন বিপ্লবী ছাত্র-জনতা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চায়। নতুন প্রজন্মের এই গভীর আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, দেশের সব বয়সের, সব পেশার, সব মতের সবাইকে বিনাদ্বিধায় এই সংগ্রামে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র দুই সপ্তাহ পার হলো। কর্মযাত্রার প্রথম সপ্তাহে যে সমর্থন পাচ্ছি, সেজন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের যে সমর্থন পাচ্ছি তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা অনুধাবন করছি, আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর।
নোবেলজয়ী এই অধ্যাপক বলেন, যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গেছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। শুধু বলবো, আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেন এদেশে জনগণই সত্যিকারের সব ক্ষমতার উৎস হয়। বিশ্বদরবারে একটি মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত হয়। তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আমাদের সফল হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান ড. ইউনূস। তিনি ভাষণের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনে ও দেশে বিরাজমান ভয়াবহ বন্যায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
দেশ ঘুসের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত, মুক্তির পরামর্শ দিন
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারকাজ শুরু করেছে। এ কাজে বড় বাধা দুর্নীতি ও ঘুস। ড. ইউনূস বলেন, সারাদেশ ঘুসের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত। কীভাবে ঘুস থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি, তার জন্য আমাদের পরামর্শ দিন। শুধু এ কাজটা নিয়ে অগ্রসর হতে পারলেই আমি মনে করি দেশের জন্য এ সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে বলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত করবো।
ড. ইউনূস বলেন, আমাদের দায়িত্ব দেশের সব মানুষকে একটি পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। পরিবারে মতভেদ থাকবে, বাগ্বিতণ্ডাও হবে। কিন্তু আমরা ভাই-বোন, আমরা বাবা-মা। আমরা কেউ কারও শত্রু না। কাউকে তার মতের জন্য শত্রু মনে করবো না। কাউকে ধর্মের কারণে শত্রু মনে করবো না। কাউকে লিঙ্গের কারণে শত্রু মনে করবো না। আমরা সবাই সমান। কেউ কারও ওপরে, কেউ কারও নিচে না। এ ধারণা আমরা জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
সব শক্তি দিয়ে দায়িত্ব পালন করবো
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা (অন্তর্বর্তী সরকার) কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করবো।’
তিনি বলেন, ‘কখন নির্বাচন হবে সেটা রাজনৈতিক বিষয়। আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলী এ লক্ষ্যে সবাই মিলে একটি টিম হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্র আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনগণ আমাদের নিয়োগ গ্রহণ করেছে। তারা যখন বলবে তখন আমরা চলে যাবো। তবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেফতার ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই বিচার করে ফেলার যে এক ধরনের প্রবণতা সেখান থেকে বের হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, জুলাই গণহত্যা স্মৃতি ফাউন্ডেশন গঠনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশ-বিদেশের সবাইকে এ ফাউন্ডেশনে অনুদানের অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি এ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছি।
তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্কারের কাজ শুরু করেছি। দেশবাসীকে অনুরোধ করব একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না।
অন্তর্বর্তী সরকার ‘লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা’ ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এই খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ সচল করেছি। ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগকে ‘দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত’ রাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সকল অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে, তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুক্ত গণমাধ্যম
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। ফ্যাসিবাদী সরকার গণমাধ্যমের ওপরও দলীয়করণ ও নির্যাতনের বোঝা চাপিয়েছিল। জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তথ্যের প্রবাহে বিদ্যমান আইনি ও অন্যান্য বাধা অপসারণ করা হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে। ইতোমধ্যে এধরনের আইনগুলো চিহ্নিত করে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।
শিক্ষা সংস্কার
শিক্ষা খাতে বিগত সরকার চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। আপনারা জানেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, নিরাপদ ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের অঙ্গীকার। একই সাথে পাঠক্রমকেও যুগোপযোগী করার কাজও দ্রুত শুরু করা হবে।
স্থানীয় সরকার
ড. ইউনূস বলেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিতামূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।
দুর্নীতি
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমাদের সকল উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সকল সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।
তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থপাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি সই ও প্রকল্পের নামে লুটপাটের তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনী
ড. ইউনূস বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবকে গুম-নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদেরও কিছু অতি উৎসাহিত সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে আমরা কলঙ্কিত দেখতে চাই না। তিনি বলেন, আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই। যেন ভবিষ্যতে কারও হুকুমে দেশপ্রেমিক কোনো বাহিনীর, পুলিশের, র্যাবের কোনো সদস্য হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হবার সাহস না করে। তাদের কাছে হুকুম যত বড় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আসুক না কেন, তারা তা উপেক্ষা করবে। ভবিষ্যতে উপরওয়ালার হুকুমে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, এমন ব্যাখ্যা কারো কাছে যাতে গৃহীত না হয়, তার ব্যবস্থা করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই- উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কৃষি-স্বাস্থ্য-আর্থিক খাত সংস্কার
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। প্রত্যেকটি খাতে কী ধরনের সংস্কার আনা হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। ভাষণে তিনি কৃষি, স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতের দুর্নীতি ও বেহাল অবস্থার চিত্র তুলে ধরে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন।
কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে : কৃষিখাত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষকের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে, কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রবাসী শ্রমিকরা যেভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, মুক্তিকামী জনগণ তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। তাদের প্রতিও সব পর্যায়ে সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা হবে।
স্বাস্থ্যখাতে জবাবদিহিতা ফেরানো হবে : ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এ খাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। হাসপাতালগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেখানে সরকারি চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থাকে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্য সেবা পান, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন : ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার আমরা উদ্যোগ সচল করেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
উন্নয়ন হবে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে তারা ওয়াকিবহালই শুধু নয়, নেতৃত্বও দিচ্ছে। তারা যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে, তা টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতি ধ্বংসকারী উন্নয়ন নয়। শুধু জিডিপি একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না। তিনি বলেন, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন, মাটি আর বাতাস ধ্বংস আর দূষিত করে যে উন্নয়ন হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের সাথে আমাদের সরকারের অবস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ একটি পৃথিবী রেখে যেতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার বিকল্প নেই। আমাদের সরকার পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। এ কার্যক্রমে তরুণ সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা হবে।
যত দাবি সব লিখিত দেন, ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না
যার যত দাবি আছে, তা লিখিতভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের স্ব স্ব দপ্তরে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। দাবি আদায়ের নামে ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে কাজে বাধা না দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৫ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এ দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যত চাওয়া, তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে, আমরা অবশ্যই তা করবো। আমাদের ঘেরাও করে এ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে কাজে বাধা দেবেন না।অর্থকণ্ঠ ডেস্ক